ভারতবিপ্লবের প্রধান হোতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শুধু আদর্শ নেতা বা বাগ্মী নন, তিনি ছিলেন দার্শনিক, চিন্তানায়ক ও শক্তিশালী লেখক। জীবনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন দেশে বসে বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাঁর অসংখ্য রচনা ও বাণী এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যা একত্র করে সমগ্র রচনাবলীর আকারে প্রকাশ করা দুরূহ, গবেষণাসাপেক্ষ ও পরিশ্রমসাধ্য কর্ম। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেই কাজেই ব্রতী হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স। ফলে, শুধু যে সুসংবদ্ধভাবে খণ্ডে-খণ্ডে এই রচনাসমগ্র প্রকাশ করাই সম্ভবপর হচ্ছে তা নয়, নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে সংযোজিত করা গেছে বহু দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য দলিল। বহু তথ্য, চিঠি, লেখা, ভাষণ, প্রতিলিপি, ছবি ও বিবৃতি যা অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা নেই। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সমগ্র রচনাবলীর সাতটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডে রয়েছে নেতাজির অনন্য আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’, দু’শো আটটি চিঠি, তরুণ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে রচিত প্রবন্ধাবলী এবং বংশধারার পরিচয়। দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নেতাজির প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’, পরিমার্জিত এবং অখণ্ড। সংকলিত হয়েছে এ-গ্রন্থ সম্পর্কে সমকালীন যাবতীয় মতামত এবং পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে একটি সাক্ষাৎকারের বিবরণ, যেখানে ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজম সম্বন্ধে এ-গ্রন্থে নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ১৯২৩ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের নিজের লেখা ও তাঁকে লেখা প্রায় দু’শোটি পত্র, ‘গোড়ার কথা’ ও ‘নতুনের সন্ধানে’ শীর্ষক ভাষণমালা। চতুর্থ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বর্মায় বন্দিজীবনে লেখা দুটি বড় ইংরেজি নিবন্ধের বাংলা তর্জমা। এ দুটিতে সুভাষচন্দ্রের অধ্যয়নের পরিধি ও গভীরতা, বস্ত্রশিল্পের ইতিহাস ও বিদেশি বস্ত্র বয়কটের তাৎপর্য বিধৃত। এ ছাড়া সংকলিত জনজীবন ও সমাজের নানাদিক নিয়ে ব্যক্ত সুভাষচন্দ্রের বহু বিবৃতি ও ভাষণমালা, ‘মন্ত্ৰবিচার’ শীর্ষক একটি রচনা ও কিছু পত্র। পঞ্চম খণ্ডে সংকলিত হয়েছে ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩-এর কালসীমায় প্রদত্ত ও রচিত সুভাষচন্দ্রের একশোটিরও বেশি বক্তৃতা ও রচনা। এই সময়ে তিনি দেশের অনন্য ও উদীয়মান এক জননেতা, ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থার প্রধান প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃত। কলকাতার মেয়র রূপে তাঁর ভাষণ ও বঙ্গবাসীর উদ্দেশে সুভাষচন্দ্রের আবেগমথিত বিদায়বাণী। ষষ্ঠ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে সুভাষচন্দ্র ও এমিলি শেঙ্কলের একশো আশিটি পত্র এবং পরিশিষ্টে আছে শরৎচন্দ্রকে লেখা সুভাষের এবং এমিলিকে লেখা শরৎচন্দ্রের চিঠি। সপ্তম খণ্ডে রয়েছে সুভাষচন্দ্র বোসের একটি বিশেষ সময়ের চিঠিপত্র, বক্তৃতা এবং প্রবন্ধ। ১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারি মাস। এক রোগপীড়িত শীর্ণ মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হল। স্ট্রেচারে শুইয়ে তাঁকে তুলে দেওয়া হল বম্বে থেকে ইউরোপগামী জাহাজে। ১৯৩৭-এর নভেম্বরে সেই মানুষটিই যখন কলকাতা থেকে কে এল এম বিমানে ইউরোপ যাত্রা করলেন, তখন তাঁর নাম কংগ্রেস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনার্থে প্রস্তাবিত। কর্মজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এইলগ্নেই তাঁকে ইউরোপ নির্বাসনে বাধ্য করা হয়। এই সংকলনের চিঠিপত্র, বক্তৃতা ও প্রবন্ধগুলি সেই সময়ের। পূর্বে অপ্রকাশিত দু’শোরও বেশি চিঠিপত্রের সঙ্গে এই খণ্ডে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রবন্ধ আছে। যেমন, ‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ও সাম্যবাদ’, ‘ইউরোপ আজ ও আগামীকাল’, ‘দূর প্রাচ্যে জাপানের ভূমিকা’ এবং ‘মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি’। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চপর্যায়ে অবস্থান করছিলেন। উপনিবেশবাদ বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামে আপসহীন নেতৃত্ব প্রদান করে তিনি পুনর্নির্বাচিত হলেন, অতি তিক্ততাময় নির্বাচন যুদ্ধে গান্ধী মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে। যদিও, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী সদস্যবৃন্দ এবং গান্ধীর প্রবল বিরুদ্ধতার মুখে তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। এই খণ্ডে, জানুয়ারি ১৯৩৮ থেকে এপ্রিল ১৯৩৯, অর্থাৎ তাঁর পদত্যাগের অব্যবহিত পর পর্যন্ত তাঁর লিখিত এবং প্রাপ্ত চিঠিপত্র এবং তাঁর লিখিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, বক্তৃতা সংকলিত হল। এই খণ্ডে সুভাষচন্দ্র বসুর বিখ্যাত হরিপুরা ভাষণটি রয়েছে। যেখানে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শক্তি এবং দুর্বলতার কথা আলোচনা করেছিলেন, সেইসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছিলেন স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন সম্পর্কে নিজস্ব দর্শন। অন্যান্য বক্তৃতা এবং রচনাগুলির বিষয় সমাজবাদ, জাতীয় পরিকল্পনা, বিজ্ঞান, সংবিধান সংক্রান্ত আলোচ্য, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, নারীর ভূমিকা, ইউরোপীয় রাজনীতি, ইত্যাদি। এই খণ্ডে প্রকাশিত পত্রাবলীর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহম্মদ আলি জিন্না এবং জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে পত্রালাপ। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক অবশ্যই এই সময়ের রচনাগুলি পড়ে সমৃদ্ধি লাভ করবেন।