সারা ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে সবচেয়ে প্রিয় ও পরিচিত দুটি নাম, রাধা আর কৃষ্ণ। এই দু’জনের যে প্রণয়-কাহিনী, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে তার তুলনা মেলে না। এই প্রণয়-কাহিনী ছড়িয়ে আছে নানান পুরাণ ও কাব্যে, গ্রাম্য গাথায়, লৌকিক গানে। পরম পণ্ডিত বা ভক্ত থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত হাজার হাজার বছর এই কাহিনীকে আপন করে রেখেছেন। তবে, এ পর্যন্ত বাংলা গদ্যে এই কাহিনীর নির্ভরযোগ্য, নিখাদ, সমগ্র রূপ রচিত হয়নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমস্ত কাব্য মন্থন করে এই রসসমৃদ্ধ ভাষ্যটি আপন ভাষায় রচনা করেছেন। কৃষ্ণের অনেক পরিচয়। বৃন্দাবনের যে-কৃষ্ণ সাধারণ মানুষের মতন, যিনি দুরন্ত রাখাল এবং যিনি রাধার প্রেমিক, শুধু তাঁর কথা বলা হয়েছে এখানে। আর রাধা যেন সম্পূর্ণ কাব্যেরই সৃষ্টি। এখানে এঁরা দেব-দেবী নন। কোনো অলৌকিকের প্রভাব নেই, এঁরা চিরকালের প্রেমিক-প্রেমিকা। বইটি শেষ করার পরেও একটু অতৃপ্তি থেকে যাবে, মনে হবে আর একটু কেন লেখা হলো না! এই অতৃপ্তিই এই ভালোবাসাকে অমর করেছে। অনেকে তাঁকে কবি হিসেবে জানেন; অনেকে জানেন কথাসাহিত্যিক হিসেকে। কিন্তু সাহিত্যের যাঁরা মনোযোগী পাঠক, তাঁরা জানেন যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায় পদ্য আর গদ্যবন্ধের দ্বন্দ্ব কত সহজে মিটে যায়, এবং কবিতা আর কথাসাহিত্যের মধ্যে কত অক্লেশে তিনি মিলন ঘটিয়ে দেন। তাঁর কবিতা যেমন বিনা দ্বিধায় মাঝে-মাঝে গদ্যের সমতটে নেমে আসে, তাঁর গদ্যও তেমনি অবলীলাক্রমে উঠে যায় কবিতার শিখরে। আসলে, কবিতাই লিখুন আর গল্প-উপন্যাস-রম্যরচনাই লিখুন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য সর্বদা দুটি স্তরকে ছুঁয়ে থাকে। একই লেখার একটি স্তরে তিনি জনপ্রিয় লেখক, সর্বজনের গ্রাহ্য, আবার অন্য স্তরে তিনি এমন-কিছু আনন্দ কিংবা বেদনার স্পর্শ ঘটিয়ে দেন, যার তাৎপর্য হয়তো ঠিক তন্মুহূর্তেই সকলের কাছে ধরা পড়ে না, কিন্তু যা আছে বলেই, একবার পড়া হয়ে যাবার পরেও, একটু সূক্ষরুচির পাঠককে আবার নতুন করে সেই লেখার মধ্যে নিবিষ্ট হতে হয়। তাঁর মনে হয়, এর মধ্যে এমন-কিছু রহস্য আছে, প্রথম-পাঠে যার আভাসমাত্র মিলেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধুই গল্প বলেন না, গল্পের মধ্য দিয়ে সত্যের দিকে এগিয়ে যান। বলা বাহুল্য, তাঁর যাত্রা এখানে প্রেম-বিষয়ক একটি পরম সত্যের দিকে।