বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সূচনা তের শতকে, অবসান আঠারাে শতকে। উনিশ শতক থেকে আধুনিক যুগের শুরু। তের শতকের পূর্বেকার কাল প্রাচীন যুগ নামে অভিহিত— প্রাচীন যুগের আরম্ভ আনুমানিক সাত শতকের মাঝামাঝি থেকে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে গদ্য ছিল না, গদ্য এসেছে আধুনিক যুগে, তাই সমস্ত সাহিত্যই রচিত হয়েছে পদ্যে। আর পদ্যে রচিত বলেই মধ্যযুগের সমগ্র সাহিত্যই সরল ও প্রাথমিক বিচারে কাব্য বা কবিতা হিসেবে বিবেচিত।
রচনার রূপ বা আঙ্গিককে মাপকাঠি ধরে গােটা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদ ও মৌলিক— দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করা যায় : আখ্যায়িকা কাব্য ও গীতিকবিতা। আখ্যায়িকা কাব্যের ধারায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, প্রণয়কাব্য, চরিতকাব্য, রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ, যুদ্ধকাব্য প্রভৃতি রচনা অন্তর্ভুক্ত। আর গীতিকবিতার ধারায় রয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, বাউলগান, কবিগান ইত্যাদি।
বিভিন্ন দেব-দেবীর মঙ্গলকীর্তন করে মধ্যযুগে এক ধরনের কাব্য সৃজিত হয়েছে। এগুলাে মঙ্গলকাব্যরূপে পরিচিত। মঙ্গলকাব্যের আবার বেশ কয়েকটি ধারা লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গলের ধারাই প্রধান। দেবতা ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যকথা ‘ধর্মমঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু। এই ধারার প্রবর্তক রামাই পণ্ডিত। দেবী চণ্ডীর মাহাত্মকথা বর্ণিত হয়েছে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ এই ধারার প্রসিদ্ধ কবি। মনসামঙ্গল কাব্যে মনসাদেবীর জয়গান কীর্তিত হয়েছে।
মধ্যযুগের তাবৎ সাহিত্যই প্রকৃতপক্ষে ধর্মনির্ভর। শুধুমাত্র রােমান্সমূলক প্রণয়ােপাখ্যানগুলাে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেম-মিলন-বিরহের কথাই এসব কাব্যে বিধৃত হয়েছে। চরিত কাব্যের মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীগ্রন্থগুলাে গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান কবিরাও নবী-রসুল এবং অন্যান্য মুসলিম ব্যক্তিত্বের জীবনী রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় আদি রামায়ণ-অনুবাদক কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ। একইভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল কাশীরাম দাসের মহাভারত'। বাঙালির জাতীয় জীবনে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারতের অবদান অপরিসীম।