প্রখ্যাত নট, নাট্যকার ও নাট্য-পরিচালক অপরেশচন্দ্রের পিতা —বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের এই পরিচয় গৌরবোজ্জ্বল হলেও তা আংশিক। স্বযুগে নিজ কীর্তিতেই খ্যাতনামা ছিলেন বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় (১৮৪২-১৯১৪)। ‘বঙ্গবাসী’তে তো নিয়মিত, সেকালের অন্যান্য বিশিষ্ট মাসিক-সাপ্তাহিকেও প্রকাশিত হত তাঁর রচনারাজি। শুভবিবাহতত্ত্ব, দেদার মজা, জননী জীবন প্রমুখ নানাবিধ গ্রন্থের প্রণেতা বিপ্রদাসের সব-থেকে সমাদৃত সৃষ্টি, নিঃসংশয়ে বলা যায়, ‘পাকপ্রণালী’। আদিতে খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত এই আলোড়ন-জাগানো গ্রন্থটিকে বিপ্রদাস নিজেই পরবর্তীকালে সম্পাদনা করে নিয়ে আসেন অখণ্ড এক সংস্করণের দুই মলাটের মধ্যে। মূল গ্রন্থের মিষ্টদ্রব্যবিষয়ক লেখাগুলি নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘মিষ্টান্নপাক’ নামের স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ। ‘মিষ্টান্নপাক’ গ্রন্থটিকে নতুন করে ছেপে এ-যুগের পাঠকদের হাতে আগেই তুলে দিয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স। এবার আনন্দ-সংস্করণে প্রকাশিত হল অখণ্ড ‘পাকপ্রণালী’। ‘পাকপ্রণালী’কে নিতান্তই রন্ধন-প্রকরণ-সংবলিত এক গ্রন্থ রূপে দেখলে বস্তুত এ-গ্রন্থের মহিমাকে খর্ব করে দেখা হয়। এ-কথা ভুললে চলবে না যে, ‘পাকপ্রণালী’র পূর্বে বাঙলা ভাষায় রন্ধনবিদ্যা সম্পর্কে কোনও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়নি। সেদিক থেকে বিপ্রদাস পথিকৃৎ। খাদ্যকে জীবনধারণের মূল ভিত্তিরূপে গণ্য করে স্বাস্থ্যসম্মত রন্ধনপ্রণালীর যাবতীয় কলাকৌশল তিনিই প্রথম গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। মাছ-মাংস- ডিম, তরিতরকারি-ফলমূল ও মসলাপাতির গুণাগুণ বর্ণনা, রুচিভেদে, কালভেদে ও শারীরিক অবস্থাভেদে আহার্যের ব্যবস্থা নির্ধারণ, আদর্শ রন্ধনশালার পরিচয়, সমগোত্রীয় রান্নার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যনির্দেশ—এ-জাতীয় বহু আনুষঙ্গিক আলোচনা ‘পাকপ্রণালী’কে বিশিষ্টতা দিয়েছে, করে তুলেছে বাঙালীর রান্নার আকর-গ্রন্থ। বাঙালী হেঁসেলের এমন কোনও রান্না মনে পড়ে না, যার প্রস্তুতপ্রণালী এ-গ্রন্থে বর্ণিত হয়নি। আবার, যে-সব বিদেশী রান্না সে-যুগেও বাঙালী রসনাকে লোলুপ করে তুলত, সে-সব রান্নাও শেখাতে ভোলেননি তিনি। ষোলটি সুপরিকল্পিত অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে বিপ্রদাস রান্নার এক অনন্য ষোড়শোপচারই যেন নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। ভাত-ডাল-শুক্তো-ডালনা-ছেঁচকি-চচ্চড়ি-দম-কালিয়া-ঘন্ট-ধোকা-ঝোল-ঝাল-অম্বল-চাটনি ইত্যাদি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পোলাও-খিচুড়ি-বিরিয়ানি-কিংবা চপ-কাটলেট-কাবাব-কোপ্তা-কোর্মার রকমারি। আবার কাস্টার্ড-পুডিং, আচার-জেলি, মণ্ড-মোরব্বা, জুস-স্টু, ফ্রুট-সুপ, বিষ্ণুভোগ-মোহনভোগও বাদ যায়নি। এমন অনেক খাবার শিখিয়েছেন বিপ্রদাস যার নামই চমকপ্রদ শুধু নয়, স্বাদও যথার্থ বৈচিত্র্যপূর্ণ। হিন্দু-অহিন্দু, আমিষভোজী- নিরামিষাশী, নিম্নবিত্ত গৃহস্থ বা সচ্ছল ভোজনবিলাসী—এ-বইতে প্রত্যেকেই তাঁর উপযোগী রান্নার হদিশ পাবেন। এমন-একটি বই অবিকল মুদ্রণে এ-যুগের পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দ পাবলিশার্স সবিশেষ আনন্দিত।