রবীন্দ্রনাথের শৈশবস্মৃতিতে যেমন, সাহিত্যকৃতিতেও তেমনই অবিচ্ছেদ্যরূপে ছড়িয়ে রয়েছে ছেলেভুলানো লৌকিক ছড়ার বিস্তর প্রসঙ্গ আর অনুষঙ্গ। শুধু তাই নয়, চিরন্তন ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই সম্পত্তিকে কীভাবে বিলুপ্তি-সম্ভাবনা থেকে উদ্ধার করা যায়, রক্ষা করা যায় সযত্ন সংগ্রহে—সে-সম্পর্কেও যথার্থ উদ্যোগ রবীন্দ্রনাথই প্রথম নেন। নিজস্ব প্রয়াস ছাড়াও কাছের-দূরের নানা মানুষজনকে তিনি উদ্দীপিত করেছিলেন লোকমুখে-ছড়িয়ে-থাকা ছড়া-সংগ্রহের কাজে। এ-ব্যাপারে তাঁর প্রধান সহযোগী হয়ে ওঠেন অবনীন্দ্রনাথ। এরপর জনসাধারণের কাছে জাতীয় এই সম্পদের সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক মূল্যকে তুলে ধরতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। ১৩০১ বঙ্গাব্দের ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘মেয়েলি ছড়া’ নামের আলোড়ন-জাগানো প্রবন্ধ (‘ছেলেভুলানো ছড়া’ নামে পরিমার্জিত আকারে যা গ্রন্থভুক্ত)। ‘সাহিত্যপরিষদ পত্রিকা’র একাধিক সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর সংগৃহীত ছড়া-সংকলন। এই অনুপ্রেরণাতেই বাংলা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহিত্যপরিষদ পত্রিকা-দপ্তরে পৌঁছতে লাগল নানা জনের পাঠানো ছড়া-সংগ্রহ। সে এক ইতিহাস। এক শো বছর পরে সেই সজীব ইতিহাসকেই ফিরিয়ে এনে এই সংকলন-গ্রন্থ। এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেই উদ্যোগ-আয়োজনের সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত, সংযোজিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধের মূল পাঠ, তুলে ধরা হয়েছে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের ‘ছেলেভোলানো ছড়া’ নামের স্বল্পজ্ঞাত তবু স্বমহিম প্রবন্ধটিকে। এ-ছাড়াও গ্রন্থের যা কেন্দ্রীয় আকর্ষণ, তা হল, রবীন্দ্র-অবনীন্দ্রনাথের যৌথ সংগ্রহ থেকে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনা ও চিঠিপত্র থেকে, অবনীন্দ্রনাথের স্বহস্তলিখিত খাতার পৃষ্ঠা থেকে, রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালার উপাদান থেকে, সাহিত্যপরিষদ পত্রিকা ও যতদূরলভ্য অন্যান্য সমূহ উৎস থেকে উদ্ধার করে এনে গ্রথিত প্রাচীন ছড়ার এক ঐতিহাসিক সংকলন। পাঠে-পাঠান্তরে, উৎস-নির্দেশে ও টীকায়, তথ্য সংগ্রহে ও বিশ্লেষণে, নিষ্ঠায় ও নিপুণতায় সম্পাদনার ক্ষেত্রেও পাঁচ শতাধিক লৌকিক ছড়ার এই সংকলন যোগ করল অনুকরণীয় এক মাত্রা।