প্রথম কাব্যগ্রন্থেই পাঠকদের স্মরণে স্থায়ী চিহ্ন গেঁথে রাখার ক্ষমতা খুব কম কবিই দেখাতে পারেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘নীল নির্জন’ সেইরকমই একটি গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের ঠিক পরবর্তী কবিগণ যখন প্রৌঢ়ত্বে পোঁছে বৈদগ্ধ্য ও তাত্ত্বিকতায় কবিতাকে খানিকটা ভারাক্রান্ত করে ফেলছেন সেই সময় নীরেন্দ্রনাথের ‘নীল নির্জন’ এসে পড়ে টাটকা সৌরভময় বাতাসের মতন। কবিতাগুলি মূলত রোমান্টিক, এবং তাতে ছন্দের দক্ষতা ও শব্দ ব্যবহারের নূতনত্ব অতি বিস্ময়কর। ‘নীল নির্জন’ প্রকাশের সময় কবির বয়েস প্রায় তিরিশ, এর আগে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিলেন, এবারে কাব্যগ্রন্থে সন্নিবদ্ধ হলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, এই কবি বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন কিছু দিতে এসেছেন। তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার বারান্দা’-য় তিনি কবিতা-প্রেমিকদের আরও বেশি মুগ্ধ করলেন এবং প্রত্যাশাও অনেক বাড়িয়ে দিলেন। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি কিছুটা সংহত হয়েছেন সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে কবি তাঁর আশা, বেদনা ও ভর্ৎসনা লিপিবদ্ধ করেছেন সতেজ, দ্বিধাহীন ভাষায়। প্রায় এই সঙ্গেই প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যনাট্য ‘প্রথম নায়ক’। তখনকার শক্তিমান কবিরা প্রায় কেউই কাব্যনাট্যের দিকে মনোযোগ দেননি, নীরেন্দ্রনাথের ‘প্রথম নায়ক’ কাব্য ও নাটককে মেলাবার এক সার্থক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’—পরপর এই দুটি বইয়ে তাঁর উত্তরণ অব্যাহত রইল এবং তিনি আবার চমকে দিলেন ‘কলকাতার যীশু’তে। আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার সব আবরণ ছিঁড়ে ফেলে কবিতার শরীরে আনলেন সরল সত্যের দীপ্তি। বাংলা কবিতার একটি নূতন ধারার প্রবর্তন করলেন তিনি। এই পর্যায় থেকে তার কবিতা বৃহত্তর পাঠক সমাজকে খুব কাছে ডেকে আনল। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে যাঁদের ভয় ছিল, তাঁদের ভয় তিনি ভাঙলেন, রোদ্দুর-বাতাস-বৃষ্টির মতন বিশুদ্ধ কবিতার রসও সহজভাবে গ্রহণযোগ্য হল। ‘কলকাতার যীশু’ এ-কালের বাংলা কাব্যজগতে একটি প্রধান দিকচিহ্ন।